কাঙ্গাল হরিনাথের গ্রন্থ তালিকা
১. বিজয়-বসন্ত-১৭৮১ শক (১৮৫৯)। ২. পদ্যপু-রীক-১২৬৯ (১৮৬২)। ৩. দ্বাদশ শিশুর বিবরণ-মাঘ ১২৬৯। ৪. চারুচরিত্র-২৬ বৈশাখ ১২৭০ (১৮৬৩)। ৫. কবিতা কৌমুদী-মাঘ ১২৭২ (১৮৬৬)। ৬. বিজয়া-ফেব্রুয়ারি ১৮৬৯। ৭. কবিকল্প -১৮৭০। ৮. অক্রুর সংবাদ বৈশাখ ১২৮০ (১৬ এপ্রিল ১৮৭৩)। ৯. সাবিত্রী নাটিকা -১২৮১ (১৮৭৮)। ১০. চিত্তচপলা-বৈশাখ ১২৮৩ (১৮৭৬)। ১১. একলব্যের অধ্যবসায়। ১২. ভাবোচ্ছ্বাস। ১৩. কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ ফকীরের গীতাবলী। ১৪. ব্রহ্মা-বেদ-১২৯৪-১৩০২। ১৫. কৃষ্ণকালী-লীলা-১২৯৯। ১৬. অধ্যাত্ম-আগমনী- ১৩০২ (৯ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫)।সেই দিনে তুই, কি করিবি রে,
ওরে মন, বল শুনি তাই আমারে।
যে দিন এসে শমনের চরে,
তোর বসে শিরে, কেশে ধরে,
টানবে রে জোরে; (ভোলা মন)
তখন বন্ধুগণে, দেখে শুনে
থোবে এনে বাহিরে।
ওরে, বাতাসে প্রাণ বাতাস মিশিলে,
যাদের ভেবে আপন করিস যতন,
তারাই সকলে; (ভোলা মন)
দিয়ে কল্সী কাচা, বাঁশের মাচা,
বিদায় দেবে তোরে রে।
ওরে মাঢীর শরীর হ’লে রে মাঢী,
কোথায় পড়ে রবে তোমার, এ সব ঘরবাঢী
সাহিত্যচর্চায় হরিনাথের শিষ্যদের মধ্যে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, দীনেন্দ্রনাথ রায় এবং জলধর সেন পরবর্তীকালে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। হরিনাথের মোট গ্রন্থ ১৮টি। মৃত্যুর পর তার রচনাসমগ্র হরিনাথ গ্রন্থাবলী (১৯০১) নামে প্রকাশিত হয়। ১৮৯৬ সালের ১৬ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আত্ম-শিক্ষা
ভোলা মন কি করিতে করিলি
সুধা বলে গরল খেলি।
সংসারে সোনার খণি পরশমণি, রতনমণি না চিনিলি;
কি বলে অবহেলে, সোনা ফেলে, আঁচলে কাঁচ বেঁধে নিলি।
আসিয়ে ভবের হাটে, বেড়াস ছুটে, লোভের মুটে তুই কেবলি;
না বুঝে তেতো মিঠে, ঘুঁটে ঘুঁটে, ভেবে মিঠে মিঠে নিলি।
না বুঝে ভালমন্দ, এমনি ধন্দ, সাপের ফন্দ গলায় দিলি;
পাশরি পরমার্থ, পুরুষত্ব, তুচ্ছ প্রেমে ম’জে র’লি।
ফিকিরচাঁদ ফকীর বলে, গেলি ভুলে, যা করিতে ভবে এলি;
এ জগৎ চিন্তামনি, আছেন যিনি, তাঁরে না চিনে মাটি হলি।
আছে কি কোন ঠিক তার, কখন তোমার,
নথি উঠে পেস হইবে।
কিরা রাত কি সকালে, সাঁজ বিকালে, যে কালে সে মন করিবে;
তখনি নথি ধ’রে অবোধ তোরে, জবাব দিতে রে তলব দেবে।
সে তলব চিঠি লয়ে, হুকুম পেয়ে যখন ধেয়ে দূত আসিবে;
তখন তোর আত্মস্বজন, স্ত্রীপরিজন, করে যতন কে ঠকাবে।
যখন সেই আদালতে জজের হাতে, অবোধ রে তোর বিচার হবে;
জীবনপঞ্জি ১৮৩৩: (৫ শ্রাবণ ১২৪০) বর্তমানে কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত কুমারখালিতে এক দরিদ্র তিলি পরিবারে জন্ম। পিতা ও মাতার নাম যথাক্রমে হলধর মজুমদার ও কমলিনী দেবী।
‘তরুর ছায়ায় পাতার কুটিরে
ভারতীয় মায়ের আসন পাতা,
কত না পুত্র বাণীর চরণে অঞ্জলি দিল,
নুইল মাথা!..
বার মাসে তের পালা-পার্ব্বণ,
যাত্রা পাঁচালী চ-ীগান,
সুস্থ সতেজ সচল শরীর,
উৎসবভরা সবার প্রাণ!’
‘বেঁচে থাকার জন্য কাঙ্গাল হরিনাথকে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়েছে। অন্ন-বস্ত্রের দীনতায় শিশু হরিনাথকে নানা রকম কর্ম করতে হয়েছে। কাপড়ের দোকানে কাজ করা, বই নকল করে দেওয়া থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যা কাঙ্গাল জীবন ধারনের তাগিদে করেননি।’
১৮৩৪: মাতা কমলিনী দেবীর মৃত্যু।
যখন আমার বয়স এক বৎসর অতিক্রম করে নাই, তখন মাতৃদেবী ইহলোক পরিত্যাগ করেন। আমি মাতৃহীন হইয়া অজ্ঞানাবস্থায় যে কত কাঁদিয়াছি, তাহা কে বলিতে পারে? খুল্লপিতামহী আমাকে প্রতিপালন করেন। আমার পিতা পুনরায় দারপরিগ্রহ করেন নাই, কিন্তু বোধহয় তন্নিমিত্তই সংসারে উদাসীন ছিলেন। তিনি বিষয়কার্য্যে তাদৃশ মনোযোগ বিধান না করায়, পৈতৃক সম্পত্তি যাহা ছিল, তৎসমুদয়ই নষ্ট হয়। সুতরাং মাতৃবিয়োগ হইতেই সাংসারিক দুঃখ যে আমার সহচর হইয়াছে, সে কথা বলা বাহুল্য। বাল্য-খেলার সময় অন্য বালকেরা ক্রীড়াপযোগী বস্তু পিতামাতার নিকট সহজে পাইয়া আনন্দ করিয়াছে, আমি তন্নিমিত্ত ক্রন্দন করিয়া মাটি ভিজাইয়াছি, এই অবস্থায় কতক দিন গত হয়। পরে বিদ্যাভ্যাসের সময় উপস্থিত হইল। পিতৃদেব স্বর্গারোহণ করিলেন, নিতান্ত নিরাশ্রয় হইয়া কত কাঁদিলাম, তাহার ইয়ত্তা নাই। Ñ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা।
১৮৪০: পিতা হলধর মজুমদারের মৃত্যু। এরপর অনাথ-অসহায় হরিনাথের বৃদ্ধ খুল্লপিতামহীর নিকটে আশ্রয়লাভ। হে দেশীয় যুবকগণ! বৃথা আপনাদের গরিমা ছাড়, জাত্যাভিমান ছাড়িয়া ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র একত্র হও, একতা অভ্যাস কর, বল ছালনা অভ্যাস কর, যাতে মাতৃভূমির মুখ উজ্জ্বল হইবে, যে সকল কু প্রথার দাসত্ব করিয়া দুর্ব্বল ্হইতেছে, তাহাদিগকে মুহূর্ত্ত মধ্যে দূর করিয়া দেও। দেখ আমাদের স্বজাতীয় অবস্থা দেখিলে কেবল ক্রন্দন করিতে হয়, যে দিন জন্মভূমির দুরাবস্থা মনে হয়, কত অসুখেই সেদিন হত। মনে হয় এ দুঃসহ যন্ত্রণার বুঝি কখনই অবসান হইবে না।
১৮৪৪: খুল্লতাত নীলকমলের সহায়তায় ও অর্থানুকূল্যে কুমারখালিতে কৃষ্ণধন মজুমদার প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সাহায্যদাতার ভাগ্য বিপর্যায়ের কারণে ‘অন্ন-বস্ত্রের ক্লেশ ও পুস্তকাদির অভাব’ দেখা দেওয়ায় বিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে।
পাঠশালার চেয়ে প্রকৃতিই ছিল কাঙ্গাল হরিনাথের অবারিত উদার বিদ্যাপীঠ-যেখানে তিনি একাগ্র নিষ্ঠাবান ছাত্রের মতো নিয়েছেন জীবনের সব ধরনের পাঠ। নানারকম প্রতিকূলাবস্থা ও প্রতিবন্ধকতা পাঠশালার শিক্ষাগ্রহণ থেকে কাঙ্গালকে বঞ্চিত করলেও মেধাবী হরিনাথ আপন চেষ্টায় শিক্ষার প্রতি ছিলেন ব্রতী।
১৮৪৫: কুমারখালি বাজারে দৈনিক দু’পয়সা বেতনে এক কাপড়ের দোকানে চাকরিতে বহাল হন। কিন্তু নীতিবোধ ও সত্যনিষ্ঠার কারণে অল্পদিনেই এই চাকরিটি তাকে হারাতে হয়।
১৮৪৯: বিদ্যাশিক্ষার উদ্দেশ্যে কলকাতায় গমন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে অচিরেই কুমারখালিতে প্রত্যাবর্তন।
১৮৫০: ’৫১টি কুঠির হেডঅফিস’ কুমারখালির নীলকুঠিতে শিক্ষানবীশির কাজে যোগদান। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতি তাঁর মন- মানসিকতার অনুকূলে না থাকায় এখানেও বেশিদিন কাজ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। নীলকরেরা, হাঙ্গামা উপস্থিত করিয়াছেন। নিরর্থক মোকদ্দমায় দুঃখী প্রজাদিগকে আবদ্ধ রাখিয়া তাহাদিগের অবাদি ভূমিতে বলপূর্বক নীল বীজ ছড়াইতেছেন। নানাপ্রকার গোলযোগে কালবিলম্ব হওয়ায় প্রজাদিগের ধান্য বুনানীর সময় উত্তীর্ণ হইয়া যাইতেছে। এ প্রদেশের অবস্থা ত এই, আবার সোমপ্রকাশ পাঠে অবগতি হইল নদিয়া প্রদেশের নীলকরেরাও হাঙ্গামা উপস্থিত করিয়াছেন।
এই সময় কুমারখালিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু কৃষ্ণধন মজুমদার মহাশয় একটি ইংরেজি স্কুল স্থাপন করিয়াছিলেন। অধ্যয়নের নিমিত্ত তাহাতে প্রবেশ করিলাম। খুল্লতাত শ্রীযুক্ত নীলকমল মজুমদার মহাশয় পুস্তকাদির ব্যয় ও স্কুলের বেতন সাহায্যে করিতে লাগিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁহার কর্ম্ম গেল। অর্থাভাবে আমার লেখাপড়াও বন্ধ হইল। স্কুলের হেডমাস্টার কৃষ্ণধন বাবু বিনা বেতনে কতদিন শিক্ষা দিয়েছিলেন; কিন্তু অন্ন-বস্ত্রের ক্লেশ ও পুস্তকাদির অভাবে আমাকে অধিক দিন বিদ্যালয়ে তিষ্টিয়া থাকিতে দিল না।
১৮৫৭: ২১ অক্টোবর, কবি ঈশ্বর গুপ্ত-সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ‘টাকা’ শিরোনামে হরিনাথের একটি প্রাথমিক রচনা প্রকাশিত হয়। হরিনাথের ‘ভাষাশিক্ষা’র জন্য কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রের ভূমিকাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
১৮৫৯: ‘নীতিগর্ভ উপাখ্যান’ হিসেবে চিহ্নিত হরিনাথের স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি ‘বিজয়-বসন্ত’-এর বসন্ত প্রকাশ। যখন দয়ার সাগর প-িত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় সুললিত বাঙ্গলা গদ্যে পুস্তকাদি প্রণয়ন করেন, সেই সময়ে হরিনাথ নদীয়া জেলার একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে বসিয়া বিজয়-বসন্ত রচনা করেন। হরিনাথ ইংরেজি জানিতেন না, ইংরেজি গ্রন্থের কোনভাবে অনুপ্রাণিত হইয়া পুস্তক লেখা তাঁহার ঘটিয়া উঠে নাই; তিনি স্বীয় প্রতিভাবলে সেই সময়ে বিজয় বসন্ত প্রকাশিত করিয়া পাঠকসমাজের মনোরঞ্জনে সমর্থ হইয়াছেন। বলিতে কি, তাহার এই পুস্তক এই শ্রেণীর উপান্যাসের মধ্যে মৌলিকতা, মধুরতা ও প্রকৃত কাব্যগুণে যথেষ্ট সমাদর লাভ করিয়াছিল।
ডাকে তোমায় ঘন ঘন,
ওহে গভীর গরজে ঘন হে;
তোমার, প্রেমপিপাসু, ওহে প্রেম জলধর!
চাতক পাখী, ঊর্ধ্বমুখে ধায় হে তখন।
উঠে যখন তরুণ ভানু,
দেখিলে তার লোহিত তনু হে;
তোমার সুশীতল, ওহে জ্যোতির্ম্ময় হে!
লোহিত জ্যোতি:
অমনি আমার হয়েছে স্মরণ।
অরূপের রূপের ফাঁদে,
পড়ে কাঁদে, প্রাণ দিবানিশি।
কাঁদলে নির্জ্জনে ব’সে, আপনি এসে,
দেখা দেয় সে রূপরাজি;
১৮৬০: হরিনাথের ভদ্রাসনের চন্ডীমন্ডপ গৃহে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন স্থাপন এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ। সমাজ হিতৈষি কাঙ্গাল হরিনাথের মানসভূমি ছিল অতি আধুনিক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের প্রকৃত কল্যাণ করতে হলে সমাজের অপরিহার্য অংশ নারী সমাজকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর তাই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন বালিকা বিদ্যালয়। ধারণা করা যায়! সেই ঊনিশ শতকে বসে গ্রামের একজন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রায় অশিক্ষিত লোক নারী শিক্ষার কথা ভেবে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নারীদের মধ্যে উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে ওষ্ঠাগত প্রাণ।
১৮৬২: বালকপাঠ্য পদ্যপুস্তক ‘পদ্যপু-রীক’-এর প্রকাশ।
হরিনাথের আত্মীয়স্বজন অবস্থাপন্ন হলেও, কেউই পিতৃমাতৃহীন বালকের ভার গ্রহণ করেননি। তাঁর এক বৃদ্ধ পিতামহী ছিলেন, তিনিই এই অনাথ বালককে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এই বিধবারও গ্রাসাচ্ছদনের বিশেষ উপায় ছিল না। তিনিকষ্টসংগৃহীত অন্নের ভাগ হরিনাথকে দিয়ে, তাকে অন্নাভাবে মৃত্যুর হাত থেকে কিছুদিন রক্ষা করেন। যার অন্নের সংস্থান নেই, তার লেখাপড়ার ব্যবস্থাকে করবে! সুতরাং হরিনাথের বাল্যকালে লেখাপড়া শিখবার সুযোগ মোটেই হয়নি। গ্রামে গুরুমশায়ের যে পাঠশালা ছিল, তাতেই তিনি কয়েকদিনের জন্য প্রবেশ করেন। একে অভিভাবকহীন তাতে নিঃসম্বল কাজেই হরিনাথ পাঠশালার শিক্ষায় একেবারেই উদাসীন ছিল। তাঁরই মুখে শুনেছি লেখাপড়ার দিকে তাঁর মোটেই মন ছিল না। এমন কি, পাঠশালায় যাবার ভয়ে একদিন তিনি সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তাঁদের বাড়ির কাছের একটা কুয়ার মধ্যে লুকিয়েছিলেন। তাহলেও পাঠশালার যা’ প্রধান শিক্ষা তা’ তিনি আয়ত্ত করেছিলেন। বার বছর বয়সে তাঁর হাতের লেখা অতি সুন্দর হয়েছিল, আর সামান্য হিসাবপত্রও তিনি করতে পারতেন।
১৮৬৩: এপ্রিল, (১ বৈশাখ ১২৭০), কলকাতা থেকে ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ।
(২৬ বৈশাখ ১২৭০), বালকপাঠ্য পদ্যপুস্তক ‘চারুচরিত্র’-এর প্রকাশ।
১৮৬৫: (আষাঢ় ১২৭১), পাক্ষিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র প্রকাশ।
পূর্ব্বাপেক্ষা বাঙ্গালা ভাষার উন্নতি হইয়াছে, ইহা সকলেই স্বীকার করেন। কিন্তু উক্ত ভাষা আশ্রয়শূন্য লতার ন্যায় কেবল ভূমিতে লুণ্ঠিতা হইতেছে। কেহই বেড়া দিতে যতœ করিতেছেন না। সুতরাং নানা প্রতিবন্ধকে উচিত মত বর্দ্ধিতা হইতেছে না, স্থানে স্থানে নানা প্রকার বাঙ্গালা পাঠশালা ও নর্ম¥াল বিদ্যালয় হইয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে যাঁহারা শিক্ষা করিতেছেন, কেবল শিক্ষকতাকার্য ব্যতীত তাহাদিগের ভাগ্যে কোন কার্যলব্ধ হইবার স¤া¢বনা নাই, ইহাতে কেহ বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা করিতে যতœ করেন না। যে ভাষা অর্থকরী হয়, সেই ভাষাই যে লোকে আগ্রহাতিশয় সহকারে শিক্ষা করেন, ইহার দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করিতে অধিক দূর যাইতে হইবে না।
১৮৬৬: (মাঘ ১২৭২), বালকপাঠ্য পদ্যপুস্তক ‘কবিতাকৌমুদীর’র প্রকাশ।
১৮৬৭: কৃষক ও পল্লীবাসীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য হরিনাথের উদ্যোগে ‘কুমারখালি সভা’ প্রতিষ্ঠা।
বিধবা, উপায়হীন শিশুসন্তান এবং বিগত ঝড় হইতে যাহারা রক্ষা পাইয়াছে, ইহাদিগের ক্লেশের পরিসীমা নাই। অনেক গ্রামের লোক চাউল না পাইয়া, ফুটি, কাঁকুড় ও লাউ প্রভৃতি ফল আহার করিয়া জীবনধারণ করিতেছে। দুর্ভিক্ষ নিবারণের অনেক উপায় উদ্ভাবিত হইতেছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হইতেছে না।
রবে না দিন চিরদিন, সুদিন কুদিন, একদিন দিনের সন্ধ্যা হবে।
এই যে আমার আমার, সব ফক্কিকার, কেবল তোমার নামঢী রবে;
হবে সব লীলা সাঙ্গ, সোনার অঙ্গ, ধূলায় গড়াগড়ি যাবে।
সংসারে মিছে বাজী, ভোজের বাজী, সব কারসাজি ফুরাইবে;
তখন যে এক পলকে, তিন ঝলকে, সকল আশা ঘুঁচে যাবে।
১৮৭০: বৈশাখ ১২৭৭), সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র প্রকাশ।
‘কবিকল্প’ গ্রন্থের প্রকাশ।
কেবল সংবাদদাতা, পত্রপ্রেরক শ্রুতিকথার প্রতি নির্ভর করিয়া গ্রামবার্ত্তার প্রকাশ হইত না। আমারা গ্রামবার্ত্তার উপযুক্ত বার্ত্তা জানিবার নিমিত্ত কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে নানাস্থান পরিদর্শন ও দূরস্থ গ্রামপল্লী অবসরমত সময়ে সময়ে ভ্রমণ করিয়াছি এবং এই প্রকার ভ্রমণ করিয়া শান্তিপুর, উলাদি উপনগর পরিদর্শনে তাহার নামোৎপত্তির কারণ ও প্রাচীন বৃত্তান্ত এবং মেহেরপুর, চাকদহ ও উলা প্রভৃতি স্থানের মহামারীর অবস্থা অনেক সংগ্রহ করেছিলাম।
১৮৭৩: ১৬ এপ্রিল, (বৈশাখ ১২৮০), ‘অক্রুরসংবাদ’ (গীতাভিনয়)-এর প্রকাশ।
: (১৮৮০), কুমারখালিতে ‘মথুরনাথ যন্ত্র’ নামে ছাপখানা প্রাতিষ্ঠা এবং অতঃপর এই প্রেস থেকেই ‘গ্রামবার্ত্তা’ মুদ্রণের ব্যবস্থা হয়। কুমারখালির মথুরানাথ যন্ত্রের কথা ধরা যেতে পারে। সমগ্র কুষ্টিয়া জেলার এটিই ছিল একমাত্র মুদ্রণযন্ত্র। সাংবাদিক, লেখক হরিনাথ মজুমদার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হরিনাথ মাসিক পত্রটি সাপ্তাহিক করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে রাজীবলোচনের সহায়তায় ১৮৭৩ সালে স্থাপন করেন ‘মথুরানাথ যন্ত্র’। হরিনাথের যাবতীয় বই-পত্র এখানেই মুদ্রিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, হরিনাথ অনুরাগী ও কুষ্টিয়া এবং আশপাশের লেখকদের বইও মুদ্রিত হতো ‘মথুরানাথ যন্ত্রে’। হরিনাথ, গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা, তাঁর গড়া বাউল ফিকিরচাঁদের দল-এসব ঘিরে গড়ে ওঠে এক বিদ্বৎসাহী চক্র যার কেন্দ্র ছিল ‘মথুরানাথ যন্ত্র’। সেখানে তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান; সুদূর মফঃস্বলে এত বড় জাগ্রত চিত্ত তখন আর দ্বিতীয় ছিল না।” শুধু তাই নয়, “হরিনাথের আদর্শে, হরিনাথের উপদেশে, হরিনাথের সহায়তায় কুমারখালি প্রদেশে অনেকের হৃদয়ে সাহিত্যানুরাগ সঞ্চারিত হয়েছিলো। যেমন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২), জলধর সেন, তন্ত্রাচার্য শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব (১৮৬০-১৯১৩), অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় (১৮৬১-১৯৩০), দীনেন্দ্র কুমার রায়, চন্দ্রশেখর কর প্রমুখ। মথুরানাথ যন্ত্রের ধ্বংসাবশেষ এখনও কাঙাল হরিনাথের বাসভিটায় অযতেœ পড়ে আছে।
১৮৭৩: সিরাজগঞ্জের প্রজাবিদ্রোহ প্রজা-পক্ষ অবলম্বন এবং ‘গ্রামবার্ত্তা’ পত্রিকার মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক হরিনাথ মজুমদারের কৃষক-প্রেমের মধ্যে কোন খাদ ছিল না। জমিদারের অত্যাচার দিনের পর দিন তিনি নিজের চোখে দেখেছেন এবং তাঁর পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে তা প্রকাশও করেছেন। অত্যাচার অসহনীয় হয়ে ওঠায় তারা যখন বিদ্রোহ করল, তখন সব প্রলোভন জয় করে হরিনাথ তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ১৮৭৪: দেশে দুর্ভিক্ষের কালে ‘গ্রামবার্ত্তা’য় গদ্য-পদ্য রচনার মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস।
সোনার বাঙলা, ভাতের কাঙাল,
চক্ষে দেখা নাহি যায়।
করে হাহাকার, কত পরিবার,
তৃণশাকে না কুলায় ॥
শাক, পাতা, ঘাস খেয়ে বার মাস,
লোকে বাঁচিবে কেমনে।
নানা রোগে ধরে, সহজেই মরে,
পথ্য ঔষধ বিহনে ॥
না দেখে উপায়, আউস আশায়,
একদৃষ্টে চেয়ে ছিল।
খন্দের সময়, দাও বৃদ্ধি হয়,
সব আশা ফুরাইল ॥
১৮৭৬: (বৈশাখ ১২৮৩), ‘চিত্তচপলা’ (উপন্যাস)-এর প্রকাশ।
১৮৭৮: (১২৮৫), ‘সাবিত্রী নাটিকা’(গীতাভিনয়)-এর প্রকাশ।
চিরদিন পরাধীন, কূলের অঙ্গনা।
কে আছে এমন সুহৃৎ, কারে বলি বেদনা ॥
হয়ে মায়ের অনুগত, বাল্যকাল করে গত,
যৌবন পতির অধীন, স্বাধীনতা জানে না।
বৃদ্ধকালে নারীগণে, রহে পুত্রের অধীনে,
অধীনতা বন্ধনে জন্মবধি পায় যন্ত্রণা ॥
বিধাতার বিনয় করি, কেহ যেন না হয় নারী
যদি নারী হয় তবে, যেন না হয় পরাধীন ॥
: (২১ চৈত্র ১২৮৫), সাহিত্যশিষ্য ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়কে লিখিত পত্রে শিলাইদহের ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়ন প্রসঙ্গের উল্লেখ।
১৮৭৯: (বৈশাখ ১২৮৬), সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র প্রকাশ বন্ধ। ইংল্যান্ড প্রভৃতি সভ্যতম প্রদেশে, যেমন মহাসভা ব্যবস্থাপক সমাজ প্রভৃতিতে, প্রাজাদিগের প্রতিনিধি নিযুক্ত আছেন, এদেশে তদ্রুপ কোন বন্দোবস্ত নাই। সুতরাং সংবাদ-পত্রিকাই প্রজাদিগের মনোগত প্রকাশের একমাত্র উপায়। তন্নিমিত্ত প্রজা এবং প্রজাপক্ষীয় সংবাদপত্রিকা সম্পাদকগণ, সংবাদ পত্রিকায় মর্ম্মবেদনা প্রকাশ করিয়া থাকেন, তাহাদিগের আক্ষেপের কারণ অধিক, সুতরাং প্রস্তাব গর্ভ ক্রন্দনবহুল হইয়া ওঠে।
১৮৮০: বাউলসাধক লালন সাঁইয়ের কুমারখালির কাঙ্গাল-কুটিরে আগমন। কাঙ্গাল হরিনাথের বাউল গান তাঁর সমকালে সমগ্র বাংলাদেশকে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কাঙ্গালের গান জনচিত্তে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছিল। কাঙ্গালের স্বহস্তলিখিত কয়েক শত গানের পা-ুলিপি কুমারখালী কাঙ্গাল-কুটিরে সংরক্ষিত আছে।
ভাব মন দিবানিশি, অবিনাশি,
সত্যপথের সেই ভাবনা।
যে পথে চোর ডাকাতে, কোন মতে,
ছোবে না রে সোনদানা;
সেই পথে মন সাধে, চল রে পাগল,
ছাড় ছাড় রে ছলনা।
সংসারের বাঁকা পথে, দিনে রেতে,
চোরডাকাতে দেয় যাতনা;
দেখ আবার ছয়ঢী চোখে, ঘুরে ফিরে,
নেয় রে কেড়ে সব সাধনা।
কখন ঝড় বাতাসে, উড়ে এসে,
জুড়ে বসে ঘোর ভাবনা;
চল যাই সত্য পথে, হায় কোন মতে,
এ যাতনা রবে না।
: ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরে’র বাউল গানের দল গঠিত। কাঙ্গাল হরিনাথ, পূর্ব্ববঙ্গের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার নিকটে তাঁহার বাউলসংগীতের দ্বারাই অসামান্য লোক বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। এই বাউলসংগীত সহজ সরল প্রাণস্পর্শী কথায় শিক্ষিত অশিক্ষিত সর্ব্বশ্রেণীর লোকই মুগ্ধ হইতেন। অল্পদিনের মধ্যে বাউলসংগীতের মধুর উদাস সুর হাটে, ঘাটে, মাঠে, নৌকাপথে সর্ব্বত্রই শ্রুত হইত। অনেক সংগীতে সংসারের অনেক সুখদুঃখের কথা ধ্বনিত হইয়াছে বটে, কিন্তু কাঙ্গাল হরিনাথের বাউলসংগীতের হৃদয়ের মধ্যে যেমন সংসারের অনিত্যতা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেমভাব জাগাইয়া তুলে, এমন আরও কিছুতেই নহে।
১৮৮২: (বৈশাখ ১২৮৬), সাপ্তাহিক ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র পুনঃপ্রকাশ। দেশীয় জমীদারগণ পূর্ব্বের ন্যায় অত্যাচার করেন না, একথা আমরা অস্বীকার করি না, কিন্তু মফঃস্বলে এখনও যে প্রকার অত্যাচার লক্ষিত হয়, তাহা অল্প নহে। জমিদারদিগের মধ্যে কেহ কেহ, ভূস্বামির ন্যায় ব্যবহার করিতে শিক্ষা করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প, শিক্ষিত ও সত্য। জমিদারদিগের জমিদারিতে অত্যাচার হয় না, এ কথা কেহ বলিতে পারিবেন না, তাঁহারা স্বয়ং অত্যাচার করিতে না পারেন, অধীনস্থ নায়েব প্রভৃতি আমলাগণ প্রজার ঘাড় ভাঙ্গিয়া রক্তপান করিবার একটি মহারাক্ষস।
১৮৮৪: (১১ মাঘ ১২৯১), ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল’ নিয়ে কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উৎসবে যোগদান। সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর সাহচর্য ও আতিথ্যলাভ।
: ২ ডিসেম্বর, ভারতের বড়লাট লর্ড রিপনের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে রিপন-প্রশাস্তি রচনা এবং এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য ‘ফিকিরচাঁদ দল’ নিয়ে পোড়াদহ রেল-স্টেশনে উপস্থিতি।
১৮৮৫: ( মাঘ, ১২৯২), সাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আমন্ত্রণে ‘ফিকিরচাঁদ ফকিরের দল’ নিয়ে ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের মাঘোৎসবে যোগদান। এই পর্যায়ে ফিকিরচাঁদের দলের ‘ভক্তিভাবপূর্ণ কীর্ত্তন ও সঙ্গীতে ঢাকার নরনারীর মধ্যে ভক্তি¯্রােত প্রবাহিত হয়’।
হরিনাথ মজুমদার তাঁহার বাউল সম্প্রদায়সহ ঢাকায় আসিয়া উৎসবে মিলিত হন। মজুমদার মহাশয়ের ভক্তিভাবপূর্ণ কীর্ত্তন ও সংগীতে ঢাকার নরনারীর মধ্যে ভক্তি¯্রােত প্রবাহিত হয়। যে দুই সপ্তাহ ইঁহারা ঢাকায় ছিলেন, মন্দির প্রাঙ্গণে এবং প্রচারকনিবাসে দিবসের অধিকাংশ সময় সংগীত কীর্ত্তন জন্য এক প্রবল ধর্ম্মোৎসাহ প্রবাহিত থাকিত।
১৮৮৬: (১২৯৩), ‘কাঙ্গাল-ফিকিরচাঁদ ফকিরের গীতাবলী’ ১ম খ-ের প্রকাশ।
আগে ভাই আপন থলে, দেখ খুলে
পরে দেখ পরের থলে
তুমি যে, ধর্ম্মাধর্ম্ম কর্ম্মকর্ম্মা,
এত কাল যা উপার্জ্জিলে;
তা ত সব মজুদ আছে, থলের মাঝে,
দেখতে পাবে মন খুঁজিলে।
এমন যা করে যখন, তার ত কখন,
ক্ষয় হয় না কোন কালে;
যবে রে মরণ যখন, যাবে তখন,
কর্ম্মফল সব সঙ্গে চলে।
তোমায় ডাকিব কেমনে ,
কিবা সম্বোধনে,
কি বচনে, আমি তা জানি না,-
তুমি ব্রহ্মা-ের পিতা, ব্রহ্মা-ের মাতা,
জগৎ-প্রসবিতা আছে জানা।
১৮৮৭: (১২৯৪), ‘ব্রহ্মা-বেদ’ গ্রন্থের ১ম ভাগের প্রকাশ।
দেলদরিয়ায় উঠছে তুফান রে,
জোয়ারভাটা নদী এ যে,
উজান ভাটা দুই রে সমান ॥
দরিয়ার টেউয়ের জলে,
একবার উপরে তোলে,
আবার রে নীচে ফেলে ভাবনা;
আবার আমাবশ্যা পূর্ণিমাতে,
বান ডাকে রে কোটালেতে
নাও ডোবে আচম্বিতে,
হ’লে একটু অসাবধান ॥
জলেতে লোনা পোরা,
বেলা ভুঁই কাদা ভরা,
কার সাধ্য আছে তাতে গুন টানা;
ঘেরা আবার ঘোরা জঙ্গলে,
উপরে বাঘ কুমীর জলে
১৮৯০: (১৫ বৈশাখ ১২৯৭), মীর মশাররফ হোসেন ‘হিতকরী’ (পাক্ষিক) পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা প্রকাশের পশ্চাতে হরিনাথের প্রেরণা ও সহযোগিতা ছিল। কেবল সংবাদদাতা, পত্রপ্রেরক ও শ্রুতিকথার প্রতি নির্ভর করিয়া গ্রামবার্ত্তার প্রকাশ হইত না। আমরা গ্রামবার্ত্তায় উপযুক্ত বার্ত্তা জানিবার নিমিত্তে কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যে নানাস্থানে পরিদর্শন ও দূরস্থ গ্রামপল্লী অবসর সময়ে সময়ে ভ্রমণ করিয়াছে এবং প্রকার ভ্রমণ করিয়া শান্তিপুর, উলাদি উপনগর পরিদর্শনে তাহার নামোৎপত্তির কারণ ও প্রাচীন বৃত্তান্ত এবং মেহেরপুর, চাকদহ ও উলা প্রভৃতি স্থানের মহামারীর অবস্থা অনেক সংগ্রহ করিয়াছিলাম।
এ মায়াপাশ কিসে ছিন্ন হয়।
আমি মায়াতে ভুলিয়ে, রয়েছি মাতিয়ে,
হতেছে সতত কত ভাবোদয়। (মনে)
যা নহে আপন, ভাবি আপন,
আশা পবন সদা রব।
আমি, আলোতে থাকিয়ে,
আলো না দেখিয়ে,
ভাবি এ সকল কেবল তমোময়।।
আমি ভবের মাঝে, দেখি খুঁজে,
আমার মত কেহই নহে?
১৮৯৫: ৯ সেপ্টেম্বর, (১৩০২), ‘অধ্যাৎ-আগমনী’ (সংগীত)-এর প্রকাশ এবং ‘মাতৃমহিমা-গ্রন্থ-রচনা।
আমি কে, আমায় কেবা চিনেছে।
আমি ঐ খেদে যে কেঁদে মরি,
আমায় সবায় ভুলেছে ॥
আকাশপাতাল সমুদয়,
কোথা আমি ছাড়া নয়,
আমি ছাড়া হ’লে অমনি হ’য়ে যেত লয়;
আমি নাই রে যথায় এমন স্থান এই,
জগৎ ব্রহ্মা-ের কোথায় আছে।
যারা চেনে আমায়, তারা বলে সর্ব্বদায়,
১৮৯৬: (২২ চৈত্র ১৩০২), গুরুতর পীড়িত হয়ে মৃত্যু-আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে এ যাত্রা সাময়িক রক্ষা পান।
: ১৬ এপ্রিল, (৫ বৈশাখ ১৩০৩), বৃহস্পতিবার অপরাহ্ন ৩-৩০ মিনিটে কুমারখালির কাঙ্গাল-কুটিরে ৬৩ বছর বয়সে পরলোকগমন। ঐদিনই সন্ধ্যায় শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
কাঙ্গাল হরিনাথের শেষ রচনা
মরণের দিন দেখ সব ফক্কিকার।
তবে কেন মূঢ় মন কর অহঙ্কার ॥
আমি ধনী আমি জ্ঞানী মানী রাজ্যপতি।
শ্মশানে সকলের দেখ একরূপ গতি ॥
কেবা রাজা, কেবা প্রজা, কে চিনিতে পারে।
তবে কেন মর জীবন ধন-অহঙ্কারে।
পুঁথি পড়, পাঁড়ি গড় কোরান পুরাণ।
ধর্ম্ম নাহি এ জগতে সত্যের সমান ॥
সত্য রাখি কর কর্ম্ম সংসার পালন।
পাপ নাহি হবে দেহে মৃত্যুর কারণ ॥
কাঙ্গাল হরিনাথের বাউল সঙ্গীত
“অনেক সংগীতে সংসারের অনেক সুখ-দুঃখের কথা ধ্বনিত হইয়াছে বটে, কিন্তু কাঙ্গাল হরিনাথের বাউল সংগীতে হৃদয়ের মধ্যে যেমন সংসারের অনিত্যতা, ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেমভাব জাগাইয়া তুলে, এমন আর কিছুতেই নহে। রূপের গর্ব্ব, ঐশ্বর্য্যের অভিমান, বাসনার আসক্তি হইতে মানুষ আপনাকে যদি নির্ম্মুক্ত করিতে চাহে, তাহা হইলে তার পক্ষে হরিনাথের সংগীত এক অমোঘ ব্রহ্মাস্ত্র-স্বরূপ। ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি জেলার অনেক লোকই কাঙ্গাল হরিনাথের সাধন সঙ্গীত শ্রবণে মনে করিতেন হরিনাথ দেবতা। সঙ্গীত উপলক্ষে কাঙ্গাল ফিকিরচাঁদ যখন যে স্থানে গমন করিয়াছেন, তখনই সেই স্থান হরিনাথের বাউল সঙ্গীতের পবিত্র ¯্রােতে প্লাবিত হইয়া গিয়াছে।
“নদী বলরে বল্ আমায় বল্ রে।
কে তোরে ঢালিয়ে দিল এমন শীতল জল রে ॥
পাষাণে জন্ম নিলে, ধরলে নাম হিমশিলে,
কার প্রেমে গ’লে আবার হইলে তরল রে।
(ওরে) যে নামাতে তুমি গল, সেই নাম একবার আমায় বল,
দেখি গলে কিনা আমার কঠিন হৃদিস্থল রে ॥
কার ভাবে ধীরে ধীরে, গান কর গভীর স্বরে,
প্রাণ মন হরে কিবা শব্দ কল কল রে;
নদীরে তোর ভাবাবেশে, যখন যায় রে বক্ষঃস্থল ভেসে
তখনই বর্ষা এসে ভাষায় ধরাতল রে।
সংগীত সংক্রান্ত বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে বাউল গান এবং তা হরিনাথ মজুমদারের। ফিকিরচাঁদ নামে হরিনাথ এগুলো লিখেছিলেন এবং বিভিন্ন জায়গায় ‘ফিকিরচাঁদের’ গান গাওয়ার জন্য ১২৮৭ সালে একটি দলও গঠন করেছিলেন। তাঁর রচিত বাঊল গানের সংখ্যা প্রায় এক হাজার।
সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ
মাতৃভাষার চর্চা জাতীয় উন্নতির সঙ্গে যে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, হরিনাথ এই মত দৃঢ়ভাবে পোষণ করতেন। ‘গ্রামবার্ত্তা‘য় তিনি তাই বলেন: যদি বঙ্গসন্তান মাতৃভাষা উপেক্ষা করিয়া পরভাষার পক্ষপাতী থাকিবেন, যতদিন মাতৃভাষা ঘৃণা করিয়া বৈদেশিক ভাষানুশীলনে সময় ক্ষেপণ করিবেন, ততদিন বঙ্গের উন্নতির আশা আমরা করি না, ততদিন জাতীয় উন্নতির কোন স¤া¢বনা দেখি না। যাহাতে দেশে মাতৃভাষার চর্চ্চা দিন দিন বৃদ্ধি পায়, যাহাতে মাতৃভাষা আদরের সামগ্রী, যতেœর ধন বলিয়া লোকের প্রতীতি জন্মে, যাহাতে সকলে বদ্ধপরিকর হইয়া মাতৃভাষার দীনবেশ ঘুঁচাইতে সমর্থ হয়েন, সে বিষয়ে চেষ্টা করা প্রত্যেক বঙ্গসন্তানের অবশ্য কর্তব্য কর্ম।
লোকশিক্ষক হরিনাথের শিক্ষাচিন্তা ছিল লোকহিতব্রতে উদ্বুদ্ধ, ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রকৃত বিদ্যাচর্চার আদর্শের উপর স্থাপিত। হরিনাথ যে কেবল জমিদারের প্রজা-পীড়নের চিত্রই তুলে ধরেছেন বা অত্যাচারিত কৃষক-প্রজার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন তা নয়, তিনি জমিদার প্রজা বিরোধ অবসানের জন্য সুপারিশ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি ‘গ্রামবার্ত্তা’য় লিখেছেন: আমরা গ্রামবার্ত্তায় জন্ম বিধি বলিয়া আসিতেছি, গবর্ণমেন্টের সহিত জমিদারদিগের যেমন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আছে, তদ্রুপ জমীদারদিগের সহিত প্রজাদিগের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সর্বতভাবে কর্ত্তব্য, তাহা হইলে সকল গোলযোগ একবার শেষ হইবে।
শুধু পত্রিকা প্রকাশ করে নয় সংগঠন তৈরি করে তার মাধ্যমেও হরিনাথ স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছেন। হরিনাথের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘কুমারখালি সভা’ (১৮৬৭) ‘আঞ্চলিক সমস্যাসমূহ বিশেষ করে কৃষকের ওপর জমিদারের অত্যাচার প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা ও নিবারণের চেষ্টা করত’। এই সভার ষষ্ঠ অধিবেশনের বিবরণ থেকে জানা যায়, এই অধিবেশনে ইনকামটেক্স, রথ্যাকর (রোডটেক্স) ও জমিদারের অত্যাচার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। আরো জানা যায় ‘এই সভায় ভদ্রলোকের সংখ্যাপেক্ষা, কৃষক প্রভৃতির সংখ্যা অধিক হয়েছিল।’ (‘গ্রামবার্ত্তা: চৈত্র, ২ সপ্তাহ, ১২৭৯) প্রকৃতপক্ষেই হরিনাথ ছিলেন পল্লীপ্রাণ এবং কৃষকপ্রেমিক। বিত্তহীন, স্বল্পশিক্ষিত, পল্লীবাসী হরিনাথের পক্ষে প্রজা স্বার্থের অনুকূলে ভূমিকা পালন সত্যিকার অর্থেই একটি বিস্ময়কর ব্যতিক্রমী ঘটনা। জমিদারের পীড়ন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে উনিশ শতকে আরো কেউ কেউ সোচ্চার হয়েছিলেন, কিন্তু জমিদারের বিরাগভাজন হয়ে, যথেষ্ট ক্ষতি ও লাঞ্ছনা স্বীকার করে হরিনাথের মতো আর কেউ কৃষক-প্রজার সুখ-দুঃখের সঙ্গে এত গভীর ও আন্তরিকভাবে সংলগ্ন হতে পারেননি। ভীতি কিংবা প্রলোভন তাঁকে তার ভূমিকাকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বৃহত্তর অর্থে, কৃষক-প্রজার অধিকার ও স্বার্থের প্রশ্নে হরিনাথের ভূমিকা ছিল অসাধারণ ও ঐতিহাসিক।
‘অত্যাচারিত প্রজা’ নামীয় প্রবন্ধে ‘গ্রামবার্ত্তা’য় বলা হয়: প্রজারা সন্তোষ পূর্ব্বক উপকার প্রদান করে, কি জমিদারগণ বুকে পাথর দিয়া আদায় করেন; সহযোগী রাজধানীতে থাকিয়া তাহা কিরূপে জানিবেন? একবার গ্রাম ও পল্লীতে আসিয়া দেখুন, এক একজন জমিদার ঐ করের নিমিত্ত কি প্রকার পীড়ন করেন। পল্লীবাসী দুর্ব্বল প্রজার সহায় সম্পত্তি নাই, নালিশ করিতে পারে না। অগত্যা অত্যাচারিত হইয়াও অত্যাচারীর পায়ে পড়ে, ইহাই যদি তাহাদিগের সন্তোষের চিত্র হয়, সে স্বতন্ত্র কথা।
কৃষক-প্রজার দুর্দশা ও দুঃখে হরিনাথ সবসময়ই তাঁর আন্তরিক সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। জীবন-সংগ্রামে বিপর্যস্ত ‘অন্ন-জন্ম-দাতা’ বাংলার কৃষকের করুণ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তাঁর ‘দুর্ভিক্ষ-পীড়িত চাষা’ নামের কবিতায় (‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’: জুলাই, ১৮৭৪)। এখানে দুর্দশার চিত্রই শুধু অঙ্কিত হয়নি তার অন্তনির্হিত কারণও বর্ণিত হয়েছে:
দুর্ভিক্ষ পীড়িত চাষা অই দেখ যায় রে!
ক্ষুধানলে দিশাহারা পাগলের প্রায় রে!
একমাত্র জীর্ণ বস্ত্র কটিতে বেস্টন
করিয়াছি; অঙ্গে নাই দ্বিতীয় বসন।
পেটেপিঠে একাকার, অস্থিচর্ম্ম সার,
চাষার দুর্গতি দেখে বুক ফেটে যায় রে!...
অন্ন বিনা অঙ্গ শীর্ণ, বিবর্ণ হয়েছে বর্ণ,
পরিধান ছিন্ন জীর্ণ, পরে শত গ্রন্থি দিয়ে ॥
বার মাস দুর্ভিক্ষ রহে, উপবাস আর কত সহে,
বলহীন শীর্ণ দেহে, কাঁদে ব্যাকুল হয়ে;
যেতে না রে দেশান্তরে, জমিদার কেশে ধরে,
মহাজন ঋণের তরে, টানে হাতে দড়ি দিয়ে ॥
পীড়িত প্রজার মধ্যে প্রতিবাদ ও প্রতিকার-চেতনা গড়ে তোলার জন্য ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র মাধ্যমে হরিনাথ বিশেষভাবে চেষ্টা করেন। ‘গ্রামবার্ত্তা’য় প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে কৃষি-শিল্প শিক্ষার উপরেও জোর দেওয়া হয়। শিক্ষার সঙ্গে জীবিকার প্রশ্নটি একসূত্রে গ্রথিত করে বলা হয়েছে: যদি কেহ বাঙ্গালার উন্নতি করিতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন, তবে অগ্রে ঐ ভাষায় শিক্ষিতদিগের উন্নতির উপায় করা কর্ত্তব্য। পরে নর্ম্যাল স্কুলে সংস্কৃতের উচ্চশিক্ষা এবং সংস্কৃত কলেজ, সংস্কৃত ও ইংরাজী অধ্যাপনার উৎকর্ষ সাধন করুক, তাহা হইলে বাঙ্গালা আপনা-আপনি উন্নত হইবে। অন্যথা ভস্মে আহুতি প্রদান সার হইবে। গোটকতক বাঙ্গালার বাঁধি বোল শিক্ষা দিলে, নি¤œ শ্রেণীর লোকের শতবর্ষেও উন্নতি হইবে না। যাহাতে তাহারা বাঙ্গালা পাঠশালার প্রথম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করিয়া শিল্পালয় ও নর্ম্যাল স্কুলে প্রবেশ করিতে পারে তাহার সুবিধা করা কর্ত্তব্য। বস্তুত: ভাষা শিক্ষা সহকারে শিল্প ও কৃষি প্রভৃতি জীবন্ত ব্যবসায় শিক্ষা প্রদান না করিলে, এদেশের নি¤œ শ্রেণীস্থ নিরন্ন প্রজাদিগের উন্নতি দূরে থাকুক কোন উপকারই দর্শিবে না। বরং অপকার হইবে। (মে ১৮৭২)।
পূর্ববঙ্গে আদর্শগত কারণে কিছু পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল যার জন্য মুদ্রণযন্ত্র প্রতিষ্ঠা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটি গোষ্ঠিগত বিশ্বাস বা ব্যক্তিগত বিশ্বাসও হতে পারে। যেমন, শিশির কুমার ছিলেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্ম মতাদর্শ প্রচারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবেও তিনি মফস্বলের বিষয়াদি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। কুমারখালির হরিনাথ মজুমদার কৃষক সাধারণের কথা বলার জন্য গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশ করেছিলেন। আবার রাজশাহীর গোঁড়া হিন্দুরা ধর্মরক্ষিণী সভা প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য হিন্দু রঞ্জিকা প্রকাশ করেছিলেন। এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন ছিল মুদ্রণযন্ত্রের।
বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়ন তথা নব জাগৃতির এক অনিবার্য পুরুষ কাঙাল হরিনাথ। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজের আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার ঊষালগ্নে শহরকেন্দ্রিক-মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক নব জাগৃতিকে প্রাণে গভীরভাবে ধারণ করে কালের যাত্রার ধ্বনি মর্মে পুষে গ্রামীণ সমাজের অন্ধ প্রকোষ্ঠ প্রজ্জ্বলিত আলোর মশাল সগৌরবে যারা উচ্চে তুলে ধরেছেন কাঙ্গাল হরিনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
“মাতাপিতা ও হারায়ে শিশুকালে
ও তার দুঃখে দিন গত চিরদিন সে ত
দীনহীন কাঙ্গাল ও মহীম-লে।
মা গো, নিজ মুখে আমার নাম রেখে হরি, শিশুকালে আমায় গেলে পরিহরি,
মা গো তার পরে পিতা, হরিলেন বিধাতা.
দুঃখের কথা স্মরি, ভাসি নয়ন জলে ॥ (মাতৃমহিমা)
কাঙ্গাল হরিনাথ নিভৃত পল্লীতে বসে সংস্কৃতিচর্চা ও লোককল্যাণের যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন, তা ব্যতিক্রমধর্মী ও বিস্ময়কর ঘটনা। এর সমতুল্য দৃষ্টান্ত নির্দেশ অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। এই বহুমাত্রিক লোকোত্তর ব্যক্তি একাধারে ছিলেন সাহিত্যশিল্পী, সংবাদ-সাময়িকপত্র পরিচালক,শিক্ষাব্রতী, সমাজ-সংস্কারক, নারীকল্যাণকামী, দেশহিতৈষী, রায়ত-কৃষকপ্রেমী, সাধক ও ধর্মবেত্তা এবং নব্য-সাহিত্যসেবীদের উদার পৃষ্ঠপোষক। মূলত তাঁর জীবনের আদর্শ ও কর্ম বিভক্ত হয়ে গেছে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, জনহিতৈষণা ও ধর্মসাধনা- এই তিন ধারায়।
হরিনাথের নাটক, যাত্রা, কবিতা, সংগীত, পাঁচালি বা প্রবন্ধের একটি বড় অংশ ধর্মাশ্রিত রচনা-মূলত ধর্মীয় প্রেরণার বশেই এগুলো রচিত। জানা যায়, ‘গ্রামের যুবকগণ যাহাতে নির্দোষ আমোদ উপভোগ করিয়া সময় অতিবাহিত করিতে পারেন, সেইজন্য হরিনাথ অনেকগুলি পৌরণিক নাটক,যাত্রা, পাঁচালী ও কীর্তন রচনা করিয়া নিজেই শিক্ষার ভার গ্রহণপূর্বক যুবকগণের দ্বারা সেই সকল নাটক ও যাত্রার অভিনয় করাইতেন’ (জলধর সেন, পূর্বোক্ত; পৃ.১৭)। সমকালে হরিনাথ প্রখ্যাত পাঁচালিকার দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭)-এর সমকক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন (জলধর সেন,‘কাঙ্গাল হরিনাথ’, ২য় খ-, কলকাতা, ১৩২১;পৃ.১-২)। তাঁর ধর্মতত্ত্ববিষয়ক রচনায়, বিশেষ করে ‘ব্রহ্মা-বেদ’ গ্রন্থে, গভীর শাস্ত্রজ্ঞানের পরিচয় মেলে।